হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসিমিন নাসের রাফিয়ি ‘বন্দেগির পথ’ শীর্ষক আখলাকি আসরে সূরা আনফালের ৪৫ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা পেশ করে মুসলমানদের উদ্দেশে বলেন— শত্রুর সাংস্কৃতিক ও মানসিক আগ্রাসনের মুখে সর্বোচ্চ সতর্কতা, দৃঢ় ঈমান ও সচেতনতা অপরিহার্য।
আয়াতুল্লাহ মোহসেন ফাকিহির দফতরে অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক আখলাকি আসরসমূহের চতুর্থ অধিবেশনে বক্তা হুজ্জাতুল ইসলাম রাফিয়ি সূরা আনফালের আয়াত ৪৫—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা কোনো শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হবে, তখন দৃঢ় থাকো এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো”— এই আয়াতের আলোকে ঈমানের স্থিতিশীলতা, আল্লাহস্মরণের তাৎপর্য এবং আধ্যাত্মিক স্থিরতার প্রতিবন্ধকতাসমূহ বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেন।
তিনি বলেন, কুরআনের এই আয়াতে মুক্তি ও সফলতার দু’টি মৌলিক উপাদানের কথা বলা হয়েছে—
১. শত্রুর মুখোমুখি হলে স্থিরতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করা, এবং
২. আল্লাহর স্মরণে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।
স্থিরতা: মুক্তির প্রথম শর্ত
কোমের হাওজায়ে ইলমিয়ার উস্তাদ হুজ্জাতুল ইসলাম রাফিয়ি বলেন, আয়াতটির অবতরণের পটভূমি ছিল উহুদের যুদ্ধ। আল্লাহর পথে ও সত্যের ময়দানে স্থির থাকা মুক্তি ও সাফল্যের প্রথম শর্ত। এই ‘ثَبات’ বা স্থিরতা তিন ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়— বাক্যে, পদক্ষেপে এবং অন্তরে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, স্থিরতা শুধু ধৈর্যের সমার্থক নয়; বরং এটি ধৈর্যেরও ঊর্ধ্বে একটি আধ্যাত্মিক গুণ, যা কুরআন ও হাদীসে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি বলেন, সত্যপথে দৃঢ়তার গুরুত্ব এতই বিশাল যে, এর অভাব মানুষকে নৈতিক ও বিশ্বাসগতভাবে পতনের দিকে ঠেলে দেয়।
ইসলামের ইতিহাস থেকে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যেমন—হযরত যুবাইর, হুজর ইবনে আদী, ওমর ইবনে হামক ও মিইসাম তাম্মার— এরা ছিলেন সত্য ও বেলায়েতের পথে অবিচলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি আরও যোগ করেন, জিয়ারতে আশুরার দোয়ায় দু’বার পুনরাবৃত্তি হওয়া বাক্য
ثَبِّتْ لِي قَدَمَ صِدْقٍ عِندَكَ مَعَ الْحُسَيْنِ وَأَصْحَابِ الْحُسَيْنِ
“হে আল্লাহ! হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীদের সঙ্গে আমার সত্যনিষ্ঠ পদক্ষেপকে দৃঢ় রাখুন”—
এই দোয়ার পুনরাবৃত্তিই প্রমাণ করে, হকের পথে অটল থাকা কতটা তাৎপর্যপূর্ণ।
স্থিরতার পাঁচটি শত্রু
হুজ্জাতুল ইসলাম রাফিয়ি বলেন, মানুষের স্থিরতা ও ঈমানের দৃঢ়তাকে বিনষ্ট করে এমন পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, যা মানুষকে আল্লাহর পথে দুর্বল করে ফেলে। এগুলো হলো—
১. তালাওন (রঙ পরিবর্তন) ও নিফাক
তিনি ব্যাখ্যা করেন, নাহজুল বালাগার ১৮৪ নম্বর খুতবায় আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেছেন, ভণ্ডদের বৈশিষ্ট্য হলো— তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী রঙ বদলায়। এক মজলিসে ইমাম আলীর (আ.) পেছনে নামাজ আদায়কে সর্বোত্তম বলে, আর অন্য আসরে মুআবিয়ার সঙ্গে ভোজে অংশ নেয় এবং আনন্দ করে। এই দ্বিমুখীতা বা তালাওন হলো স্থিরতার বিষ, যা মানুষের নৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়।
২. তাসওয়িফ ও তাফরিত (কাজ ফেলে রাখা)
إياك والتسويف
— “কাজকে কালকের জন্য ফেলে রেখো না”— এই হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামীকাল করব’, ‘সময় হলে করব’— এই প্রবণতা মানুষকে আমল ও ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। সময়ক্ষেপণ এক প্রকার আত্মপ্রবঞ্চনা, যা ধীরে ধীরে মানুষকে আল্লাহর বন্দেগি থেকে বঞ্চিত করে।
৩. হকের ব্যাপারে সন্দেহ ও দ্বিধা
ড. রাফিয়ি বলেন, সন্দেহ ও দ্বিধা মানুষকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করে। তিনি সিফফিন যুদ্ধের হারেস নামের এক ব্যক্তির ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, যখন হারেস বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, তখন আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি তো হক ও বাতিলকেই চেনো না!” অর্থাৎ, সত্য চেনা ছাড়া সত্যের মানুষকেও চেনা সম্ভব নয়।
৪. তাওজিহ বা আত্মপ্রবঞ্চনা ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া
তিনি বলেন, কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা ঢাকতে নানা অজুহাত তৈরি করা এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। তাবুক যুদ্ধের সময় কিছু লোক অজুহাত দিয়েছিল— “রোমের নারীরা অনাবৃত থাকে, তাই যেতে পারব না” কিংবা “আমার ঘরে রক্ষী নেই, পরিবার নিরাপদ নয়”— এসবই জিহাদ থেকে পলায়নের বাহানা ছিল। কুরআন তাদেরকে মিথ্যাবাদী ও দায়িত্বপরায়ণতা থেকে পলায়নকারী বলে চিহ্নিত করেছে।
৫. সুস্থির কর্মে শৈথিল্য ও অলসতা
তিনি বলেন, আল্লাহর আদেশ পালনে উদাসীনতা, দায়িত্বের প্রতি অবহেলা এবং আমলে শৈথিল্য মানুষকে ঈমানের স্থিরতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এমন শৈথিল্য আধ্যাত্মিক পতনের অন্যতম কারণ।
আল্লাহর স্মরণের প্রতিবন্ধকতা
এরপর বক্তা আল্লাহর স্মরণ বা যিকরুল্লাহ থেকে মানুষকে বিরত রাখে এমন তিনটি প্রধান প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করেন—
১. শয়তানের অনুপ্রবেশ
শয়তান মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে আল্লাহর স্মরণ থেকে তাকে বিমুখ করে। মানুষের অন্তর যত দূষিত হয়, ততই যিকর কমে যায় এবং গাফেলতা বেড়ে যায়।
২. ধন-সম্পদ ও সন্তানদের মোহ
তিনি কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে তোমাদের উদাস না করে। যারা এমনটি করে, তারাই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত।”
তিনি বলেন, অনেক মানুষ সম্পদ ও সন্তানদের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে আল্লাহর পথে উদাসীন হয়ে পড়ে, ইবাদত ও দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যায়।
৩. অতিরিক্ত আশা ও লেহব-লাহবের আসক্তি
তিনি বলেন, দীর্ঘ আশা, অর্থহীন বিনোদন, অশ্লীল সংগীত, জুয়া, এবং অহেতুক আনন্দ-উল্লাস মানুষকে গাফেল করে দেয়। এসবই আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে এবং হৃদয়ের আধ্যাত্মিকতা বিনষ্ট করে।
শত্রুর সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র: বিশ্বাস ও জীবনধারার পরিবর্তন
আলোচনার শেষাংশে হুজ্জাতুল ইসলাম রাফিয়ি বলেন, আজকের দুনিয়ায় শত্রুরা ইসলামি সমাজে আক্রমণ করছে দুটি মৌলিক দিক দিয়ে— বিশ্বাস পরিবর্তন এবং জীবনধারার পরিবর্তন।
তিনি বলেন, শত্রুরা এখন মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা, নৈতিক বিশ্বাস ও পারিবারিক জীবনধারাকে বিকৃত করার চেষ্টা করছে। তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কৌশলের মাধ্যমে মিশনারি খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং ‘পোষা কুকুর সংস্কৃতি’ র মতো পশ্চিমা অভ্যাস মুসলিম সমাজে প্রলুব্ধকরভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসবের উদ্দেশ্য মুসলমানদের মূল্যবোধ ও পরিচয়কে ক্ষয় করা।
তিনি জোর দিয়ে বলেন— “আজকের যুগে শত্রু দুটি বিষয়ে সর্বাধিক মনোযোগ দিয়েছে: এক— মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তার রূপান্তর, দুই— জীবনধারার পরিবর্তন। এই দুটি দিক থেকেই মুসলিম সমাজে আঘাত হানা হচ্ছে। তাই আলেম সমাজ, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই জাগ্রত হতে হবে। আলেমদের উচিত সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এবং সমাজে সত্য, ঈমান ও আল্লাহস্মরণের সংস্কৃতি জোরদার করা।”
তিনি আরও বলেন, শত্রুর এই পরিকল্পনা কোনো সামরিক যুদ্ধ নয়; এটি মানসিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। সুতরাং, এর মোকাবিলা করতে হলে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ, বিশ্বাসের দৃঢ়তা, এবং আধ্যাত্মিক চেতনার নবায়ন অপরিহার্য।
এই আখলাকি বক্তব্যে হুজ্জাতুল ইসলাম নাসের রাফিয়ি কুরআনের দৃষ্টিতে ‘স্থিরতা ও আল্লাহস্মরণ’কে সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ঈমানের দৃঢ়তা ও আল্লাহর স্মরণই মানুষকে শয়তান, নফস ও সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করতে পারে। বর্তমান যুগে যখন শত্রু বিশ্বাস ও জীবনধারা পরিবর্তনের পরিকল্পনায় সক্রিয়, তখন মুসলমানদের উচিত তাদের আধ্যাত্মিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করা এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের পথে অটল থাকা।
আপনার কমেন্ট